https://eeraboti.cloud/uploads/images/ads/Trust.webp
Breaking News

আসন্ন প্রযুক্তি বিপ্লব: বাংলাদেশ কি প্রস্তুত? যেভাবে আমরা বিশ্বমঞ্চে জায়গা করে নিতে পারি Summary:

top-news
  • 05 Dec, 2025
https://eeraboti.cloud/uploads/images/ads/eporichoy.webp

পরিবর্তনের হাওয়া ও আমাদের অবস্থান

পৃথিবীটা এখন আর আগের মতো নেই। সকালে ঘুম থেকে উঠে স্মার্টফোনের স্ক্রিনে তাকালেই বোঝা যায়, পরিবর্তন কত দ্রুত ঘটছে। একটা সময় ছিল যখন আমরা ভাবতাম কম্পিউটার চালানো শিখলেই জীবন সেট। কিন্তু এখন? এখন চ্যাটজিপিটি (ChatGPT) বা মিডজার্নি (Midjourney)-র মতো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই (AI) এসে চোখের পলকে কাজ করে দিচ্ছে, যা করতে আগে ১০ জন মানুষের লাগত ৭ দিন। এটাকে বলা হচ্ছে ‘ফোর্থ ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভোলিউশন’ বা চতুর্থ শিল্প বিপ্লব। প্রশ্ন হলো, এই ঝড়ের বেগে ধেয়ে আসা প্রযুক্তি বিপ্লবের জন্য বাংলাদেশ কতটুকু প্রস্তুত?

আমরা মুখে বলছি ‘স্মার্ট বাংলাদেশ ২০৪১’-এর কথা। কিন্তু মাঠ পর্যায়ের বাস্তবতা কী? আমাদের তরুণরা কি আসলেই গ্লোবাল মার্কেটের সাথে পাল্লা দেওয়ার যোগ্য হয়ে উঠছে, নাকি আমরা এখনো সেই পুরোনো আমলের মুখস্থ বিদ্যায় আটকে আছি? আজকের এই লেখায় আমরা একদম খোলামেলা আলোচনা করব—কোথায় আমাদের ঘাটতি, কোথায় অপার সম্ভাবনা, এবং ঠিক কীভাবে প্রস্তুতি নিলে বাংলাদেশ আগামী দিনের প্রযুক্তি বিশ্বে নেতৃত্ব দিতে পারবে।

১. শিক্ষাব্যবস্থা: সার্টিফিকেট নাকি দক্ষতা?

সোজাসাপ্টা কথা হলো, আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা দিয়ে আগামীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা কঠিন। আমাদের স্কুল-কলেজগুলোতে এখনো জিপিএ-৫ পাওয়ার যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা, তা প্রযুক্তির দুনিয়ায় অচল। গুগল, অ্যামাজন বা টেসলা এখন আর আপনার সার্টিফিকেট দেখে না, তারা দেখে আপনি কী কাজ পারেন।

  • মুখস্থ বিদ্যাকে না বলুন: আমাদের কারিকুলামে পরিবর্তন আসছে, এটা ভালো দিক। কিন্তু শিক্ষকদেরও আপডেট হতে হবে। বাচ্চাদের ছোটবেলা থেকেই ‘ক্রিটিক্যাল থিঙ্কিং’ বা জটিল সমস্যার সমাধান কীভাবে করতে হয়, তা শেখাতে হবে।

  • কোডিং হোক নতুন ভাষা: ইংরেজির মতো কোডিং বা প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ জানাও এখন বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত। শুধু কম্পিউটার সায়েন্সের ছাত্রদের জন্য নয়, বরং ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, এমনকি আর্টস ব্যাকগ্রাউন্ডের ছাত্রদেরও ডেটা সায়েন্সের বেসিক জানা দরকার।

  • ভোকেশনাল শিক্ষার গুরুত্ব: জাপানের বা জার্মানির দিকে তাকান। তাদের উন্নতি কিন্তু ভোকেশনাল বা কারিগরি শিক্ষার ওপর দাঁড়িয়ে। আমাদের দেশে পলিটেকনিক বা কারিগরি শিক্ষাকে ‘কম মেধাবীদের জায়গা’ ভাবা হয়—এই মানসিকতা বদলাতে হবে। রোবোটিক্স, মেকাট্রনিক্স এবং আইওটি (IoT) নিয়ে ব্যবহারিক শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।

২. ফ্রিল্যান্সিং থেকে এন্টারপ্রেনারশিপ: চাকা ঘোরানোর সময়

বাংলাদেশ ফ্রিল্যান্সিংয়ে বিশ্বে দ্বিতীয় বা তৃতীয় অবস্থানে আছে—এটা গর্বের বিষয়। কিন্তু ভয়ের বিষয় হলো, আমরা বেশিরভাগই ‘লো-স্কিলড’ কাজ করছি। যেমন—ডেটা এন্ট্রি, সাধারণ গ্রাফিক্স ডিজাইন বা এসইও। এআই আসার ফলে এই কাজগুলো সবার আগে বিলুপ্ত হবে।

  • স্কিল আপগ্রেডেশন: এখন আর শুধু লোগো ডিজাইন করে টিকে থাকা যাবে না। আমাদের শিখতে হবে প্রম্পট ইঞ্জিনিয়ারিং, ব্লকচেইন ডেভেলপমেন্ট, সাইবার সিকিউরিটি এবং মেশিন লার্নিং।

  • স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম: শুধু বিদেশি বায়ারের কাজ না করে, আমাদের নিজেদের সমস্যা সমাধানের জন্য স্টার্টআপ তৈরি করতে হবে। পাঠাও, বিকাশ বা শপআপ-এর মতো আরও হাজারটা স্টার্টআপ দরকার। এর জন্য দরকার সরকারি ও বেসরকারি ভেঞ্চার ক্যাপিটালের সহজলভ্যতা। আমাদের তরুণদের চাকরির পেছনে না ছুটে চাকরি দাতা হওয়ার সাহস জোগাতে হবে।

৩. তৈরি পোশাক শিল্প (RMG) ও অটোমেশনের চ্যালেঞ্জ

আমাদের অর্থনীতির মেরুদণ্ড হলো গার্মেন্টস শিল্প। কিন্তু এখানেও বড়সড় ধাক্কা আসছে। উন্নত দেশগুলো এখন ‘স্মার্ট ম্যানুফ্যাকচারিং’ বা রোবট দিয়ে কাপড় সেলাইয়ের দিকে ঝুঁকছে। যদি রোবট দিয়ে কম খরচে ইউরোপ-আমেরিকায় কাপড় তৈরি সম্ভব হয়, তবে তারা কেন বাংলাদেশ থেকে শিপিং খরচ দিয়ে কাপড় কিনবে?

  • প্রযুক্তির সমন্বয়: আমাদের গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিগুলোকে এখনই অটোমেশনের আওতায় আনতে হবে। শ্রমিকদের ছাঁটাই না করে তাদের মেশিন অপারেটর বা মেইনটেইন্যান্সের প্রশিক্ষণ দিতে হবে।

  • হাই-ভ্যালু প্রোডাক্ট: শুধু সস্তা টি-শার্ট না বানিয়ে, আমাদের এখন হাই-এন্ড বা দামী পোশাক, টেকনিক্যাল টেক্সটাইল (যেমন অগ্নিনিরোধক কাপড়) তৈরির দিকে ঝুঁকতে হবে, যেখানে প্রযুক্তির ব্যবহার বেশি।

৪. কৃষি ও এগ্রিটেক: মাটির সাথে প্রযুক্তির বন্ধন

বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। কিন্তু আমাদের কৃষকরা এখনো সনাতন পদ্ধতিতে চাষাবাদ করছেন। এখানে ড্রোন টেকনোলজি, আইওটি সেন্সর এবং বিগ ডেটা বিপ্লব ঘটাতে পারে।

  • স্মার্ট ফার্মিং: জমিতে কখন সার লাগবে, কখন পানি লাগবে—তা এখন সেন্সর দিয়ে মোবাইল অ্যাপেই দেখা সম্ভব। এতে খরচ কমবে, ফলন বাড়বে।

  • সাপ্লাই চেইন: কৃষকের পণ্য সরাসরি ভোক্তার কাছে পৌঁছাতে অ্যাপ-ভিত্তিক সাপ্লাই চেইন তৈরি করতে হবে, যাতে মধ্যস্বত্বভোগীরা মুনাফা লুটে নিতে না পারে। ‘আইফার্মার’ (iFarmer) এর মতো উদ্যোগগুলো এখানে আশা জাগাচ্ছে।

৫. অবকাঠামো ও ইন্টারনেটের গতি

ঢাকায় বসে ফাইভ-জি (5G) নিয়ে কথা বলা সহজ, কিন্তু গ্রামের ফ্রিল্যান্সার ভাইটি যখন লোডশেডিংয়ে কাজ করতে পারেন না, তখন সব পরিকল্পনা ভেস্তে যায়।

  • নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট: প্রযুক্তির বিপ্লবের প্রধান শর্ত হলো হাই-স্পিড ইন্টারনেট এবং স্টেবল ইলেকট্রিসিটি। সাবমেরিন ক্যাবলের ব্যান্ডউইথ বাড়াতে হবে এবং গ্রামে-গঞ্জে ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্ক আরও শক্তিশালী করতে হবে।

  • ডেটা সেন্টার: আমাদের নিজস্ব ডেটা সেন্টার বা ক্লাউড ইনফ্রাস্ট্রাকচার তৈরি করতে হবে। বিদেশি সার্ভারের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে তথ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থেই জরুরি।

৬. সাইবার সিকিউরিটি: ডিজিটাল বাংলাদেশের রক্ষাকবচ

যত বেশি ডিজিটাইজেশন হবে, হ্যাকিং বা সাইবার অ্যাটাকের ঝুঁকি তত বাড়বে। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনা আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে।

  • নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ তৈরি: আমাদের দেশে দক্ষ সাইবার সিকিউরিটি এক্সপার্টের অভাব প্রকট। সরকারিভাবে হ্যাকাথন আয়োজন এবং এথিক্যাল হ্যাকিং শেখার সুযোগ করে দিতে হবে।

  • সচেতনতা: সাধারণ মানুষকে ফিশিং, ম্যালওয়্যার এবং ওটিপি (OTP) জালিয়াতি সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। গ্রাম পর্যায়ে ডিজিটাল লিটারেসি ক্যাম্পেইন চালানো দরকার।

৭. মানসিকতা পরিবর্তন: নতুনকে বরণ করার সাহস

সবচেয়ে বড় বাধা প্রযুক্তি নয়, আমাদের ‘মাইন্ডসেট’। আমরা নতুন কিছু গ্রহণ করতে ভয় পাই। সরকারি অফিসগুলোতে এখনো ফাইলের স্তূপ জমে থাকে, যেখানে একটা সফটওয়্যার দিয়ে কাজটা নিমেষে করা সম্ভব।

  • রেড টেপিজম বা আমলাতান্ত্রিক জটিলতা: উদ্যোক্তারা ট্রেড লাইসেন্স বা লোন পেতে গিয়ে জুতো ক্ষয় করে ফেলেন। এই প্রসেসগুলো সম্পূর্ণ ডিজিটাল ও অটোমেটেড হতে হবে।

  • ব্যর্থতাকে মেনে নেওয়া: সিলিকন ভ্যালিতে ব্যর্থতাকে অভিজ্ঞতার অংশ ধরা হয়। আমাদের দেশে স্টার্টআপ ফেল করলে তাকে ‘অপদার্থ’ বলা হয়। এই সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে।

উপসংহার: আগামীর বাংলাদেশ

সামনে যে সময় আসছে, তা দুর্বলদের জন্য নয়। প্রযুক্তি বিপ্লব কাউকে ছাড় দেবে না। কিন্তু বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো এর জনশক্তি। আমাদের জনসংখ্যার বিশাল একটা অংশ তরুণ। এই তরুণদের হাতে যদি সঠিক প্রযুক্তি তুলে দেওয়া যায়, যদি তাদের সঠিক গাইডলাইন দেওয়া যায়, তবে বাংলাদেশ শুধু প্রযুক্তির ব্যবহারকারী হবে না, হবে প্রযুক্তির উদ্ভাবক।

সময় খুব কম। এখনই কোমর বেঁধে নামতে হবে। সরকার, ইন্ডাস্ট্রি এবং আমাদের মতো সাধারণ জনগণ—সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। আসুন, আমরা ভয়ে পিছিয়ে না গিয়ে প্রযুক্তির এই নতুন ঢেউয়ে সার্ফিং করতে শিখি। কারণ, ভবিষ্যৎ তাদেরই, যারা পরিবর্তনের সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে জানে।

https://eeraboti.cloud/uploads/images/ads/Genus.webp

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *